।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
আর দেরি নেই, আমি আসছি
-সুনির্মল বসু
আউট – আউট। বি. রয় বোল্ড। ক্লিন বোল্ড।আম্পায়ার মাথার উপরে বিশিষ্ট নির্দেশ-সূচক আঙুল তুলে বি. রয়-এর উইকেট পতনের পরোয়ানা জারী করেছেন। ‘আম্পায়ার’স কল ইজ কল।’ তাই বি. রয় অর্থাৎ বন্ধন রায় কাঁধে ব্যাট ফেলে প্যাভেলিয়ন মুখী হয়েছে। ক্রিজে আসার পর মাত্র তিনটে বল খেলেছে বন্ধন।প্রথম বলটা একটু নিচু হয়ে এসেছিল। সাবধানী ও সতর্ক বন্ধন ওই বলটা খেলবার মত কোন ঝুঁকি নেয়নি। দ্বিতীয় বল-টাতে গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। বন্ধন ব্যাট চালিয়েছিল শেষ-মুহূর্তে।কোন রান সম্ভব হয়নি, বিপদও কিছু ঘটেনি।কিন্তু দিনের তৃতীয় বলটি সোজা এসে উইকেটে ধাক্কা দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্ধন রায় বোল্ড।
প্যাভেলিয়নে ফেরবার পথে, গাল্যারী থেকে বি রয়-এর উদ্দেশ্যে কিছু খিস্তি বর্ষিত হল।দর্শকদের আসন থেকে কে একজন হেঁড়ে গলায় বললেন – “এটা পুরো হাফ কেলানে মাইরি। এমন পয়মাল কে কেন যে মাঠে নামায়!” আবার একজন হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে বলে উঠলেন -“দাদা কি নেবুর বল এ প্যাকটিস করেছেন নাকি? এইচ -ডি পাল কোথাকার!”
বি রয় অর্থাৎ বন্ধন রয় আজকাল দর্শকদের এইসব বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভালো খেলতে না পারার জন্য এইসব অভিযোগ-গালাগাল তো শোনাটাই স্বাভাবিক। তবে এ-সবে খারাপ তো লাগেই। কাঁটার আঘাত তো জ্বালা দেয়-ই।
বন্ধন কলকাতার একটি ক্রিকেট দলের একদা নির্ভর-যোগ্য ব্যাটসম্যান। একসময় কলকাতার ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছে মাঠের হিরো। ওর খেলার স্টাইল নিয়ে মিডিয়াতে নানা প্রসংশাসূচক আলোচনা হয়েছে। সবাই বলতো – ‘গুরু, এ সিওর সচিন নইলে সৌরভ।’
অথচ, ইদানিং মাঠে গিয়ে ক্রিজে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারছে না বন্ধন। ব্যাড্ প্যাচ্, যাকে বলে।
সেদিন মা গীতা দেবী তাকে বলছিলেন- ‘খেলোয়াড় না হয়ে তুই যদি একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতিস্ , তাহলে একটা চাকরি পেতিস্ বন্ধন।’
বাবা মাকে বল্ছিলেন – ‘প্লেয়ার হোচ্ছে, না গুষ্টির মাথা হোচ্ছে।’
একদিন এই খেলার সূত্রেই ভাস্বতী সান্যালের সঙ্গে ওর আলাপ। বড় ম্যাচ ছিল ফ্লাড লাইটের আলোয়। বন্ধন সেদিন বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে সংহার -মূর্তিতে ব্যাট করেছিল। দর্শকদের অভিনন্দনে সেদিন ভেসে যেতে হয়েছিল ওকে। অ-পরাজিত থেকে বন্ধন সেদিন দেড়শো রান একাই করে বসে।
ভাস্বতী তখন টেলিফোন ভবনে চাকরি করতো। ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে এসে বন্ধনকে বলে -‘একটা অটোগ্রাফ প্লিজ্।’
সেই প্রথম সাক্ষাৎ। তারপর কতবার পার্ক স্ট্রিট, আকাশবানী ভবনের রাস্তায়, কফিখানায়, কিংবা আউটট্রাম ঘাটে দেখা হয়েছে দু’-জনের।
মিলেনিয়াম পার্কে যেতে যেতে একবার ভাস্বতী বন্ধন-কে বলেছিল -‘অ্যাই তোমাকে ভালো খেলতে হবে কিন্তু! তোমার জন্য আমার যেন খুব গর্ব হয়।’
বন্ধন মৃদু হেসেছিল।
ইদানীং বন্ধনের খেলার সেই ধার নেই।
চার-পাশে অনুরাগীদের ভিড় নেই। ক্লাব কর্তারা এখন অনেকেই বন্ধন-কে এড়িয়ে চলেন।
এক ক্লাব-কর্তা দেবু দত্ত সেদিন ওকে ডেকে বলেছেন – ‘এই ক্লাবে আপনাকে রাখা যাবে না। নেক্সট সেশানে আপনি অন্য ক্লাব দেখুন্!’
খেলা পড়ে যাবার পর, ভাস্বতীও আজকাল ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। অথচ, আগে আগে ভাস্বতীর ফোন আসতো রাতের দিকে। কোনো কোনো দিন বন্ধনও ভাস্বতীকে ফোন করতো।
-হ্যালো
-কে?
-বলো তো কে?
-জানি-না।
-তবে রেখে দিলাম।
-এই শোনো শোনো। আজ বিকেলে একবার দেখা করো না আমার সঙ্গে।
-কেন, কি ব্যাপার?
-আমার অফিস-কলিগ মোহর আর সোনালী একবার তোমাকে সামনাসামনি দেখে কথা বলতে চায়।
-কখন যাব?
-ঠিক বিকাল সাড়ে-পাঁচটায়।
-ঠিক আছে, যাব।
আজকাল বন্ধনের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে ভাস্বতী। বন্ধন একদিন টেলিফোন-ভবনে ওর সাথে দেখা করতে গেলে, ভাস্বতী ওকে বলেছে- ‘তোমার জন্য মাঠে যাওয়া বন্ধ করতে হবে আমাকে। কি যা – তা খেলছ আজকাল তুমি!’
বন্ধন লোকমুখে জেনেছে, ইদানীং ভাস্বতী অফিস কলিগ্ সুদীপ্ত মুখার্জি বলে এই ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে নতুন করে প্রেম শুরু করেছে।
বন্ধন ভাস্বতী-কে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ও একদিন ঠিক ঘুরে দাঁড়াবেই।ভাস্বতী সে-সব কথায় আমল দেয়নি। ফুটো নৌকায় কেউ উঠতে চায় না।
বন্ধন তাই আজকাল এইসব কারণে দারুণ মানসিক অবসাদে ভুগছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে, বন্ধন নিজেকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। নিজেকে বলে -‘আমি একটা যাচ্ছেতাই, আমি কেউ নই অথবা হতে পারি না।’
সেদিন সকালে বন্ধন নিজের ড্রয়িং- রুমে বসে, ওর কোচ সিদ্ধার্থ মিত্তিরের ফোন এলো- ‘মন খারাপ কোরো না। সব পেশাতেই মাঝে মাঝে ব্যাড্ প্যাচ্ আসে। তুমি আমার বাড়িতে এসো, কথা আছে।’
বন্ধন পরেরদিন সকালে কোচের লেক টাউনের ফ্লাটে হাজির। কলিং বেল বাজাতে ওর মেয়ে কঙ্কনা দরজা খুলে দিল।
-বসুন! বাপি বাথরুমে,আপনাকে বসতে বলেছেন।
বন্ধন সোফায় বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল।
কোচ এলেন।
‘তোমার সঙ্গে আমার মেয়ে কঙ্কনার যোগাযোগ নেই বুঝি! ও নাম করা ইন্টিরিআর ডেকরেটর। আর মা-মনি, ও হলো বন্ধন রায়। ভালো ব্যাটসম্যান। ইদানীং ওর খেলাটা একটু ডাউন-পজিশনে। শিগগিরই কাটিয়ে উঠবে নিশ্চয়-ই ।’
কঙ্কনা মুগ্ধ চোখে বন্ধনের দিকে তাকালো।কপাল থেকে উড়ু উড়ু চুল -গুলো সরিয়ে দিয়ে বললো-
আপনার খেলা কখনো দেখিনি, বাপির কাছে আপনার অনেক প্রসংশা শুনেছি। আপনার খেলার স্টাইলটা অনেকটা নাকি মনসুর আলি খান পতৌদির মত।’
বন্ধন লজ্জায় পড়ে যায় কঙ্কনার কথা শুনে।
কোচ বলেন-‘তুমি আজকাল মাঠে আসছো না কেন? কাল থেকে তোমায় মাঠে দেখতে চাই।’
বন্ধন বিদায় নেবার সময় কঙ্কনা বললো-‘আবার আসবেন।’
বন্ধন মনে মনে বলল–আমার এই অন্ধকার জীবনে তুমি আলো হবে ?আমি তাহলে আর একবার ঘুরে দাঁড়াবো।
সেদিন প্রাকটিস্ থেকে ফেরার পথে সামনে একটা স্যান্ট্রো গাড়ী এসে বন্ধনের সামনে দাঁড়ালো।
স্টিয়ারিং-এ কঙ্কনা। হাসি-হাসি মুখে বললো- ‘উঠে আসুন্। বাড়ী যাবেন তো?’
বন্ধন সামনে উঠে বসলো।
-প্র্যাকটিস সেরে ফিরছেন?
-হ্যাঁ
-বাপি বলছিলেন, মাঠে আপনি খুব ঘাম ঝরাচ্ছেন।
-তাই বুঝি! কিন্তু কনফিডেন্স পাচ্ছি না।
-পাবেন-পাবেন। শূণ্য থেকে শুরু করুন।
বন্ধন মনে মনে বললো- তুমি তো জানো না কঙ্কনা, আমি একজন হেরো মানুষ। ভাস্বতী আমায় একলা ফেলে গেছে, সেই থেকে আমার ইচ্ছা-শক্তিটাও তলানিতে।
ততক্ষণে বন্ধনের বাড়ি এসে গেছে।
বন্ধন গাড়ী থেকে নেমে পড়লো।বললো- ‘আসুন না, মায়ের সঙ্গে আলাপ করবেন।’
কঙ্কনা বললো – ‘আজ নয়,অন্যদিন এসে মাসিমার হাতে চা খেয়ে যাব।’
‘আপনি এলে ভালো লাগবে’ – বন্ধন বললো।
‘আসবো তো। আমি একজন যোগ্য মানুষের হেরে যাওয়া দেখতে রাজী নই।’ –কঙ্কনা বললো।
গলির মোড়ে এরপর ওর গাড়ী মিলিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে ক্লাব- পর্যায়ের খেলায় বন্ধন ভালো রান পেতে শুরু করেছে।
দলের তিন-নম্বর ব্যাটসম্যান হিসাবে ওর জায়গা প্রায় পাকা। ইন্ডিয়া-টীমে বন্ধনকে নেওয়া যাবে কিনা, তা’ নিয়ে শলা-পরামর্শ চলছে।
মিডিয়াগুলোতে বি রয়-কে নিয়ে জোরদার জল্পনা শুরু হয়েছে।
বন্ধন বরাবর সৌরভ ভক্ত। মনে মনে বলছে-দাদা, যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমি পারব না কেন? আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।
বন্ধন ভালো খেলতেই, দেবু দত্ত তাকে ফোন করে বলছেন —
‘তোমার মত ডিপেন্ডেবল ব্যাটসম্যানকে ক্লাব কখনো হাত ছাড়া করতে পারে? আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি ?’
বন্ধন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে।
কঙ্কনা আজ ওর অফিসে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলেছে।
একটা হলুদ ট্যাক্সি ভাড়া করে বন্ধন আজ কঙ্কনার সাথে দেখা করতে এলো।
কঙ্কনা তখন অফিসের ফাইলে চোখ রেখে ভারী ব্যস্ত।
-আসতে পারি?
-অবশ্যই। বসুন, কি সৌভাগ্য আমার!
-কেন?
-আমি একজন ভালো মানুষকে হারতে দিইনি।
-তুমি আমায় ভালোবাসো,কঙ্কনা?
কঙ্কনা মাথা নিচু করলো। এভাবে ভালোবাসায় সম্মতি একমাত্র মেয়েরাই জানাতে পারে।
বন্ধনের মনে হলো, কোন দুরের পাহাড়তলীতে ওরা দুজন অঝোর ধারায় ঝর্নার নীচে দাঁড়িয়ে ভালোবাসায় ভিজে যাচ্ছে।
পরদিন কোচ সিদ্ধার্থ মিত্র বন্ধনকে ডেকে বললেন-
‘বলেছিলাম না, তুমি পারবে। বাই দ্য ওয়ে, কঙ্কনা আমায় বলেছে , ও তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আর একটা গুড নিউজ দিই, তুমি ইন্ডিয়া টীমে চান্স পেয়েছো।
স্বপ্নের গাড়ীটা এভাবে সামনে এসে পড়বে, বন্ধন কখনো ভাবেনি।
বিকেলে কঙ্কনার সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটে দেখা।চারদিকে বড়দিনের আলোর মেলা।
কঙ্কনা বললো-‘এই যে মশাই, কেমন লাগছে?’
বন্ধন বললো- ‘কঙ্কনা, আমি আর হারবো না।আমি পারবো।’
দূরে কোথাও জনপ্রিয় শিল্পীর গান বাজছিল-“চলে যেও না,আর দেরী নেই, আমি আসছি।।’
বন্ধন বললো –‘তুমি সাথে থাকলে,আমি সব পারবো।’
কঙ্কনা বললো- ‘সকালে গাছে গাছে ফুল ফোটে, কিন্তু কুঁড়ির উপর রাতের কুয়াশা আর ভোরের শিশিরের আনুষঙ্গ থাকা চাই।’
বন্ধন বললো-‘তুমি সঙ্গে থাকো কঙ্কনা। আর দেরী নেই,আমি আসছি।’